ছায়ার কান্না

গল্পের নাম:

ছায়ার কান্না




অধ্যায় ১: শুরু

রাত তখন প্রায় দশটা। রিমঝিম বৃষ্টি পড়ছে, আর তার সঙ্গে বিদ্যুতের ঝলকানি। রাস্তার বাতিগুলোও যেন একে একে নিভে যেতে চাইছে।

রাকিব আর তার স্ত্রী তানিয়া গাড়ি চালিয়ে এগোচ্ছিল শহরের বাইরের দিকে। কয়েক সপ্তাহ আগে তারা একটি পুরনো বাড়ি কিনেছে। বাড়িটি বহুদিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। স্থানীয় মানুষজন বলত, ওই বাড়িতে কেউ থাকতে চায় না। কিন্তু রাকিব এসব কথা বিশ্বাস করেনি।

“তুমি নিশ্চিত আমরা এখানে থাকব?” তানিয়া একটু শঙ্কিত ভঙ্গিতে বলল।

রাকিব হাসল। “আরেহ, পুরনো গল্প! মানুষ ভয় পায় বলে এসব বানায়। চিন্তা করো না। বাড়িটা বেশ সুন্দর হবে, একবার আমরা সাজিয়ে নিলে।”

বাড়িতে পৌঁছানোর পর, রাকিবের সন্দেহ হলো কেন লোকজন এ বাড়ি নিয়ে এত ভয় পায়। তার চোখে এটা ছিল নিখুঁত একটি জায়গা—বড় উঠান, প্রচুর গাছপালা, আর চারদিকে নির্জনতা।

তারা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতরটা অন্ধকার, কুয়াশার মতো একধরনের ঠাণ্ডা বাতাস যেন তাদের চারপাশে জড়িয়ে ধরল। তানিয়া কাঁপতে কাঁপতে বলল, “এত ঠাণ্ডা কেন?”

“এটা তো পুরনো বাড়ি, কিছুদিন খালি ছিল। স্বাভাবিক ব্যাপার,” রাকিব উত্তর দিল।

তারা প্রথম রাতটি কোনও রকমে কাটাল। তবে মাঝরাতে তানিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। সে শুনতে পায় একটি মৃদু কান্নার শব্দ। প্রথমে ভেবেছিল হয়তো কল্পনা করছে, কিন্তু শব্দটি ক্রমেই পরিষ্কার হতে থাকে।

“রাকিব!” তানিয়া ফিসফিস করে ডাকল।

“কী হয়েছে?”

“তুমি শুনতে পাচ্ছো? কেউ যেন কাঁদছে!”

রাকিব গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল, সে কিছু শুনতে পেল না। তানিয়া ভয়ে চুপ হয়ে গেল।


ছায়ার কান্না

অধ্যায় ২: পুরনো ডায়েরি

পরদিন সকালে তানিয়া রাতের ঘটনা নিয়ে রাকিবকে বলল। রাকিব বিষয়টি গুরুত্ব দিল না। সে হাসতে হাসতে বলল, “তুমি হয়তো স্বপ্ন দেখেছ।”

তানিয়া বিরক্ত হয়ে বলল, “এটা স্বপ্ন ছিল না। আমি স্পষ্ট শুনেছি। একটা বাচ্চার কান্নার মতো মনে হচ্ছিল।”

রাকিব আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল। “আচ্ছা, আমি আজ রাতে জেগে থাকব। যদি কিছু হয়, দেখব।”

দিনটি বাড়ির ভেতর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় কেটে গেল। পুরনো আসবাব, কাগজপত্র, আর ধূলোমাখা জিনিসপত্র সরাতে গিয়ে তানিয়া একটি পুরনো ডায়েরি খুঁজে পেল।

ডায়েরির মলাট ছিল ধূলিমলিন। প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা ছিল:
“আমার নাম শায়লা। এটা আমার গল্প।”

ডায়েরিটি পড়তে শুরু করল তানিয়া। সেখানে লেখা ছিল একটি ছোট মেয়ের জীবনকাহিনি, যে এই বাড়িতে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকত। ডায়েরির পরের পাতাগুলোতে মেয়েটি তার একাকিত্ব, তার ভয়, আর অদ্ভুত ঘটনার কথা লিখেছে।

“আজ রাতেও সেই ছায়া আমাকে দেখল,” লেখা ছিল এক পৃষ্ঠায়।
“আমি বাবাকে বলেছি, কিন্তু তিনি হেসে উড়িয়ে দিলেন। কিন্তু আমি জানি, ওটা আসল। আমি জানি, ওটা আমাকে চায়।”

তানিয়া ডায়েরি পড়তে গিয়ে শিউরে উঠল। সে বুঝতে পারল, বাড়ির এই ইতিহাস বেশ গভীর এবং অশুভ।

অধ্যায় ৩: কান্নার রহস্য

রাতে রাকিব ও তানিয়া একসঙ্গে শুয়েছিল। তানিয়া ডায়েরির কথা বলেছিল রাকিবকে। কিন্তু রাকিব বলল, “এগুলো হয়তো কোনো কল্পকাহিনি। তুমি ভেবে ভয় পাচ্ছো।”

ঠিক তখনই, ঘরের কোণ থেকে মৃদু কান্নার শব্দ শোনা গেল। এবার রাকিবও শব্দটি শুনতে পেল।

“এটা কি বাচ্চার কান্না?” রাকিব ফিসফিস করে বলল।

তারা দুজনেই ভয়ে জমে গেল। তানিয়া বলল, “দেখছো? আমি বলেছিলাম। এই শব্দ কাল রাতেও শুনেছিলাম।”

কান্নার শব্দ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল। শব্দটি যেন তাদের শোবার ঘরের বাইরে থেকে আসছে। রাকিব সাহস করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলতেই কাঁপা কাঁপা বাতাসের সঙ্গে যেন কেউ তার কানে ফিসফিস করে বলল, “আমাকে বাঁচাও।”

রাকিব পিছিয়ে আসতে গিয়েও পা বাড়াতে পারল না। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল এক ছোট ছায়ামূর্তি। তার চেহারা স্পষ্ট নয়, কিন্তু ভয়াবহভাবে শিশুর আকৃতি মনে হচ্ছিল।

অধ্যায় ৪: শায়লার অতীত

পরদিন সকালে তানিয়া ও রাকিব স্থির করল, তারা বাড়ির ইতিহাস খুঁজে দেখবে। স্থানীয় লাইব্রেরিতে গিয়ে তারা জানতে পারল, এই বাড়িটি ১৯৮০ সালে নির্মিত হয়েছিল। একসময় এখানে রহমান পরিবার বসবাস করত।

তারা জানতে পারল, রহমান পরিবারের একমাত্র মেয়ে শায়লা মাত্র দশ বছর বয়সে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়। লোকজন বলত, সে রাতে তার ঘরে অদ্ভুত কিছু ঘটেছিল। কেউ কেউ বলত, শায়লার আত্মা এখনও এই বাড়িতে ঘোরে।

তারা ডায়েরি থেকে আরেকটি সূত্র পায়। শেষ পাতায় লেখা ছিল:
“ও আমাকে নিয়ে যাবে। আমি জানি। আমাকে কেউ বাঁচাবে না।”

অধ্যায় ৫: ভূতের অভিশাপ

রাত গভীর হলে অদ্ভুত ঘটনা বাড়তে লাগল। তানিয়া বারবার ছায়ামূর্তিকে দেখতে পেত। কান্নার শব্দ আরও জোরে শোনা যেত। এক রাতে, তানিয়া ও রাকিব একসঙ্গে দেখল ছায়া যেন তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

“আমাকে ছেড়ে দাও!” ছায়া হঠাৎ চিৎকার করে উঠল।

তানিয়া বলল, “তুমি কী চাও? কীভাবে তোমাকে সাহায্য করব?”

ছায়া মৃদু স্বরে বলল, “আমাকে বাঁচাও। ও আমাকে আটকে রেখেছে।”

তানিয়া এবং রাকিব বুঝতে পারল, এই বাড়িতে শুধু শায়লার আত্মা নেই। আরও কিছু অশুভ শক্তি তাকে আটকে রেখেছে।

অধ্যায় ৬: মুক্তি

তারা স্থানীয় এক পুরোহিতের সাহায্য নিল। পুরোহিত বলল, “এখানে এক অপশক্তি বাস করে, যা শায়লার আত্মাকে আটকে রেখেছে। তাকে মুক্ত করতে হলে তোমাদের সাহস ও বিশ্বাস প্রয়োজন।”

পরদিন রাতে পুরোহিত বাড়িতে এসে একটি আচার শুরু করল। পুরো বাড়ি গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেল। বাতাস ভারি হয়ে উঠল। আচারের মধ্যেই ছায়া হাজির হলো।

“তোমরা আমাকে মুক্ত করতে চাও?” ছায়া বলল।

পুরোহিত মন্ত্র পাঠ করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে ছায়ার আকৃতি ফিকে হয়ে আসতে লাগল। তার কান্নার শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। আচারের শেষে ছায়া একবার তানিয়ার দিকে তাকাল, যেন কৃতজ্ঞতা জানাতে চাইছে। তারপর এক নিমিষে মিলিয়ে গেল।

উপসংহার

অভিশাপমুক্ত হওয়ার পর বাড়িটি আবার আগের মতো শান্ত হয়ে গেল। রাকিব আর তানিয়া বুঝতে পারল, শায়লার আত্মা অবশেষে মুক্তি পেয়েছে। তারা বাড়িটি বিক্রি করে শহরে ফিরে গেল।

তবে কিছু কিছু রাতে, তানিয়া এখনও অনুভব করে, যেন দূর থেকে কেউ তাকে দেখছে। ছায়া মুক্ত হলেও, তার স্মৃতি থেকে কি সত্যিই মুক্তি পাওয়া যায়?

Comments